সিলেট : ‘প্রকৃতিকন্যা’ সিলেট সৌন্দর্যের এক নান্দনিক আধার। প্রকৃতি তার সিলেট নামক এই কন্যাকে রঙ-রূপ-রসে সাজিয়েছে অপার হস্তে। বৃহত্তর সিলেটের পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রূপ-লাবণ্যের অপূর্ব এক ভাণ্ডার। সৌন্দর্যে এই ভাণ্ডার যে কাউকেই মুগ্ধ করে পলকেই।
এমনিতেই সারা বছর পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত থাকে সিলেট। কিন্তু যেকোনো উৎসব-পার্বণে পর্যটকদের উপচেপড়া ঢল নামে সিলেটে। এবারের পহেলা বৈশাখের তথা বাংলা নববর্ষের উৎসবেও পর্যটকদের পদভারে গমগম করবে সিলেটের বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলো।
ইংরেজি মাসের হিসেবে আগামী ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ। এদিন সারাদেশে সরকারি ছুটি। ওইদিন বৃহস্পতিবার হওয়ায় টানা তিনদিন সরকারি ছুটির ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কেননা, শুক্র-শনিবার সরকারি সাপ্তাহিক ছুটির দিন। টানা তিন দিন ছুটি পাওয়ার ফলে এবার সিলেটে পর্যটকদের আনাগোনা একটু বেশিই হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বৃহত্তর সিলেটের পর্যটন নিয়ে কাজ করা ‘ভিজিট সিলেট’র প্রতিষ্ঠাতা সিলেটের নাজিমগড় রিসোর্টের সাবেক ব্যবস্থাপক হাসান মোরশেদ বলেন, সারা বছরই সিলেটে পর্যটকদের স্রোত থাকে। আর কোনো উৎসব হলে তো কথাই নেই! এবারের পহেলা বৈশাখে টানা তিন দিন ছুটি মিলছে। এজন্য পর্যটক সমাগম অনেক বেশি হবে।
তিনি জানান, ইতিমধ্যেই সিলেটের বেশিরভাগ হোটেল, মোটেল, রিসোর্টগুলো বুকড হয়ে গেছে।
সিলেটের কোথায় ঘুরবেন : লালাখাল : স্বচ্ছ নীল জলরাশি আর দুই ধারের অপরূপ সোন্দর্য, দীর্ঘ নৌপথ ভ্রমণের সাধ যেকোনো পর্যটকের কাছে এক দুর্লভ আর্কষণ। তেমনি এক নির্জন মনকাড়া স্থান লালাখাল। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের স্থান এবং রাতের সৌন্দর্যে ভরপুর এই লালাখাল সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার সন্নিকটে অবস্থিত। সারি নদীর স্বচ্ছ জলরাশির ওপর দিয়ে নৌকা অথবা স্পিডবোট দিয়ে যেতে পারেন লালাখালে। সিলেট থেকে সেখানে যাবার পথে দু’চোখ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়বে কিন্তু সৌন্দর্য শেষ হবে না!
যাত্রা শেষে লালখাল চা বাগানের ফ্যাক্টরি ঘাটে পৌঁছাবেন আপনি। মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেন নদীর পানির দিকে। কি সুন্দর নীল, একদম নিচ পর্যন্ত দেখা যায়। ভারতের চেরাপুঞ্জির ঠিক নিচেই লালাখালের অবস্থান। চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে উৎপন্ন এই নদী বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত।
সিলেট শহর থেকে মাইক্রোবাস, বাস কিংবা সিএনজি অটোরিকশায় সরাসরি লালাখাল যাওয়া যায়। আবার সিলেট শহর থেকে সারিঘাট গিয়ে সেখান থেকে নৌকায় লালাখাল পৌঁছানো যায়। মাইক্রো ভাড়া যাওয়া-আসা ২-৩ হাজার টাকা, প্রাইভেটকার দেড় থেকে দুই হাজার টাকা পড়বে। বাস কিংবা লেগুনায় সারিঘাট যেতে ভাড়া ৪০-৬০ টাকা পড়বে। সেখান থেকে নৌকায় যাওয়া-আসার ভাড়া ৭০০-১৫০০ টাকা পড়বে।
রাতারগুল : ‘সিলেটের সুন্দরবন’ খ্যাত বাংলাদেশের একমাত্র জলাবন (সোয়াম্প ফরেস্ট) হচ্ছে রাতারগুল। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের গুয়াইন নদীর দক্ষিণে রাতারগুলের অবস্থান। সিলেট শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরত্বে এর অবস্থান।
জলের মধ্যে ভেসে থাকা সবুজ বৃক্ষ, মাথার ওপর তার ছায়া, সুনীল আকাশ, নৌকায় করে রাতারগুলে ঘুরে বেড়ানো তো অদ্ভূত রোমাঞ্চকর এক অ্যাডভেঞ্চারই! এই বনে কিছু সাপ ছাড়াও আছে বানর, মাছরাঙা, পানকৌড়ি, কানাবক, সাদাবক, ঘুঘুসহ নানা জাতের অসংখ্য পাখি।
দলবেধে রাতারগুল যাওয়াই ভালো। সিলেট নগরীর চৌহাট্টা থেকে মাইক্রোবাসে করে যাওয়াই ভালো। ভাড়া যাওয়া-আসা বাবদ সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা।
মাইক্রোবাস আপনাকে গোয়াইন নদীরে তীরে নামিয়ে দেবে। এখান থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে রাতারগুলের পাশে যেতে আপনার খরচ পড়বে সর্বোচ্চ ১০০০ হাজার টাকার মতো। পরে ডিঙি নৌকায় করে রাতারগুল বনের ভেতর ঘুরতে আপনাকে সর্বোচ্চ ১২০০ টাকার মতো খরচ করতে হতে পারে। কথা বলে ঠিক করে নেওয়াই ভালো।
অন্যদিকে নগরীর আম্বরখানা থেকে সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যে গোয়াইন নদীর তীরে চলে যেতে পারেন।
জাফলং : জাফলংয়ের সৌন্দর্যের বর্ণনা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বে রয়েছে জাফলংয়ের ব্যাপক পরিচিতি। রূপ-লাবণ্যের এমন স্বপ্নপুরি আর কোথায় পাবেন!
সিলেট থেকে বাস, মাইক্রোবাস বা সিএনজি অটোরিকশায় করে জাফলং যেতে সময় লাগে সর্বোচ্চ দেড় ঘণ্টা। বাসে জনপ্রতি ভাড়া ৫৫ টাকা, সিএনজি অটোরিকশা রিজার্ভ ৬০০-৭০০ টাকা, মাইক্রোবাস রিজার্ভ ১৫০০-১৮০০ টাকা।
বিছনাকান্দি : সুউচ্চ পাহাড়। পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা বিশাল ঝর্ণা। নিচে সারি সারি পাথরের ওপর ছিটকে পড়ছে ঝর্ণার স্বচ্ছ জল। পাহাড়, মেঘ, আকাশ আর স্বচ্ছ জলের জলকেলি মিলিয়ে বিছনাকান্দি মুগ্ধতার এক অনন্য রূপ।
সিলেট নগরীর আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজি অটোরিকশায় গোয়াইনঘাটের হাদারপাড় যেতে হবে। এজন্য জনপ্রতি ৮০ টাকা দিয়ে যাওয়া যায়। আবার রিজার্ভ অটোরিকশায় ৪০০-৪৫০ টাকার মধ্যেই যাওয়া যায়।
হাদারপাড় বাজারে নেমে মসজিদের পাশে খেয়াঘাট থেকে নৌকা রিজার্ভ করে যেতে হবে। ভাড়া প্রথমে মাঝিরা একটু বেশিই হাঁকাবে। কিন্তু রাজি না হয়ে একটু দরকষাকষি করুন। দেখবেন, সর্বোচ্চ ৮০০ টাকার মধ্যেই যাওয়া-আসায় রাজি হয়ে যাবে।
লোভাছড়া চা বাগান : পাহাড়ের মেঘের প্রতিচ্ছবি, যেন হাত দিয়েই ছোঁয়া যাবে মেঘ! চা বাগানে সবুজ কুঁড়ি, কচি ছেলে-মেয়ের নিষ্পাপ চাহনি, চা শ্রমিকদের জীবনাচরণ, ব্রিটিশ আমলের ক্বিনব্রিজ, নদীর বুকে পাল তোলা নৌকার ভেসে চলা, নদী তীরের জীবন... কতো কি! সিলেট বেড়াতে এলে লোভাচড়ায় না যাওয়া মানে চরম বোকামি!
লোভাচড়া যেতে সিলেট শহর থেকে বাসে ৪০ টাকা ভাড়া দিয়ে যেতে হবে কানাইঘাট উপজেলার সদর নৌকা ঘাটে। সেখান থেকে জনপ্রতি ২৫ টাকা ভাড়া দিয়ে নৌকা করে যেতে হবে লোভা চা বাগানে।
চা বাগান দেখে নৌকা করে আবার যেতে পারেন লোভাছড়া পাথর কোয়ারিতে। পাথর শ্রমিকদের জীবন, ভারতের সীমান্ত এলাকা, বালুচর, পাহাড়-মেঘের মিতালি দেখতে পারবেন সেখানে। নৌকায় ভাড়া ১৫-২০ টাকা নেবে জনপ্রতি।
পাংথুমাই : পেছনে ভারতের মেঘালয় রাজ্য আর বয়ে চলা পিয়াইন নদীর মিতালিতে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের পাংথুমাই গ্রাম দেশের সবচেয়ে সুন্দরতম গ্রামগুলোর একটি! গ্রামের পাশেই বড়হিল নামক মায়াবি এক ঝর্ণার কলকল ধ্বনিতেই বিমুগ্ধ হওয়া যায়।
সিলেট শহরের আম্বরখানা থেকে সিএনজি অটোরিকশায় ৪০০-৪৫০ টাকায় গোয়াইনঘাট বাজারে গিয়ে পরে পশ্চিম জাফলং হয়ে পাংথুমাই যেতে হবে।
মালনীছড়া ও লাক্কাতুড়া চা বাগান : সিলেট শহরের উপকণ্ঠেই রয়েছে মালনিছড়া ও লাক্কাতুড়া চা বাগান। মাত্র ১৫-২০ মিনিটেই শহর থেকে এ চা বাগান দুটিতে যাওয়া যায়। সিএনজি অটোরিকশাতেই যাওয়া ভালো।
লাক্কাতুড়া চা বাগানেই রয়েছে দেশের প্রথম গ্রিন গ্যালারির ক্রিকেট স্টেডিয়াম। নগরীর জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, আম্বরখানা যেকোনো স্থান থেকেই যাওয়া যায় চা বাগান দুটিতে।
এসব আকর্ষণীয় মনোমুগ্ধকর স্থান ছাড়াও সিলেট মহানগরীর মধ্যে থাকা ঐতিহ্যবাহী ক্বিনব্রিজ, আলী আমজাদের ঘড়ি, ওসমানী শিশু উদ্যান, নগরীর উপকণ্ঠে থাকা ড্রিমল্যান্ড ওয়ার্টার পার্ক, জাকারিয়া সিটি, অ্যাডভেঞ্চার ওয়ার্ল্ডে যেতে পারেন।
এ ছাড়া হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, শ্রীপুর, মাধবপুর লেক, মাধবকু- জলপ্রপাত, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, জাদুকাটা নদী প্রভৃতি স্থানেও।
যেভাবে সিলেট আসবেন : ঢাকার কমলাপুর ও ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে করে সিলেট আসা যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির বাস নিয়মিতই ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম থেকে সিলেটে আসে।
যেখানে থাকবেন : সিলেটে থাকার জন্য রয়েছে বেশ ভালো সুবিধা। রয়েছে উন্নতমানের রোজভিউ হোটেল, হোটেল ফরচুন গার্ডেন, হোটেল সুপ্রিম, হোটেল ডালাস, হোটেল অনুরাগ, হোটেল মেট্টো ইন্টারন্যাশনাল প্রভৃতি। এ ছাড়া কিছুটা কম ভাড়ার হোটেল গুলশান, হোটেল কায়কোবাদ, হোটেল হিল টাউন, হোটেল দরগাহ গেট রয়েছে।
আপনি যদি প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকতে চান, সবুজে চোখ জুড়াতে চান, তবে থাকতে পারেন নাজিমগড় রিসোর্ট কিংবা শুকতারা রিসোর্টে। সিলেট আসার আগে পরিচিত কারো সঙ্গে যোগাযোগ করে এলে কিংবা গাইড ঠিক করে এলে সবচেয়ে ভালো হয়। এক্ষেত্রে পর্যটন নিয়ে কাজ করা কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন